
ভারতীয় চলচ্চিত্র: কালজয়ী সৃষ্টির উত্তরাধিকার থেকে বর্তমানের পথচলা
ভারতীয় চলচ্চিত্র জগৎ বরাবরই তার সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং বৈচিত্র্যময় গল্পের জন্য পরিচিত। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচক সংস্থা ‘ফিপ্রেসকি’-র ভারতীয় শাখা সর্বকালের সেরা দশটি ভারতীয় সিনেমার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে, যা আমাদের cinematic ঐতিহ্যের গভীরতাকে আবার মনে করিয়ে দেয়। এই তালিকার শীর্ষে থাকা কালজয়ী সিনেমাগুলো যেমন আমাদের গর্বিত করে, তেমনই বর্তমান সময়ের পরিচালকরাও নতুন নতুন গল্প এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভারতীয় সিনেমাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।
সর্বকালের সেরা দশ: এক ঝলক
‘ফিপ্রেসকি ইন্ডিয়া’-র ৩০ জন সদস্যের ভোটে নির্বাচিত এই তালিকায় এমন কিছু চলচ্চিত্র স্থান পেয়েছে যা কেবল ভারতে নয়, বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হয়েছে।
-
পথের পাঁচালী (১৯৫৫): সত্যজিৎ রায়ের এই প্রথম পরিচালনা শুধু একটি সিনেমার থেকে অনেক বেশি। এটি ছিল ভারতীয় সিনেমাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমাটি আজও ক্রিস্টোফার নোলানের মতো বিশ্বখ্যাত পরিচালকদের অনুপ্রেরণা। ফিপ্রেসকি-র তালিকায় এটি শীর্ষস্থান পেয়েছে।
-
মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০): তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আরেক কিংবদন্তী বাঙালি পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের কালজয়ী সৃষ্টি। দেশভাগের যন্ত্রণা এবং এক সাধারণ মেয়ের বেঁচে থাকার লড়াইকে কেন্দ্র করে তৈরি এই সিনেমাটি পরিচালকের ‘দেশভাগ ট্রিলজি’-র প্রথম কিস্তি এবং তাঁর সবচেয়ে প্রশংসিত কাজগুলির মধ্যে অন্যতম।
-
ভুবন সোম (১৯৬৯): মৃণাল সেন পরিচালিত এই হিন্দি ছবিটি ভারতের ‘নিউ ওয়েভ’ সিনেমার অন্যতম পথপ্রদর্শক হিসেবে গণ্য হয়। এই সিনেমার মাধ্যমেই অমিতাভ বচ্চন ধারা বর্ণনাকারী হিসেবে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন এবং এটি জাতীয় পুরস্কারও অর্জন করে।
-
এলিপ্পাথায়াম (১৯৮১): মালয়ালম পরিচালক আদুর গোপালকৃষ্ণনের এই সিনেমাটি ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে একটি মাইলফলক। কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ারের পর এটি লন্ডন চলচ্চিত্র উৎসবে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের পুরস্কার জেতে।
-
ঘাটশ্রাদ্ধ (১৯৭৭): কন্নড় সিনেমার প্রখ্যাত পরিচালক গিরিশ কাসারাভাল্লির প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের এই ছবিটি আন্তর্জাতিক স্তরে বহু প্রশংসা পেয়েছে। এটি প্যারিসের ন্যাশনাল আর্কাইভে প্রদর্শিত একমাত্র ভারতীয় সিনেমা হিসেবেও সম্মানিত হয়।
-
গরম হাওয়া (১৯৭৩): দেশভাগের প্রেক্ষাপটে এক মুসলিম পরিবারের সংগ্রামকে কেন্দ্র করে এম. এস. সথ্যু-র এই সিনেমাটি নির্মিত। এটিকে দেশভাগ নিয়ে তৈরি অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
-
চারুলতা (১৯৬৪): সত্যজিৎ রায়ের দ্বিতীয় ছবি হিসেবে এই তালিকায় স্থান পেয়েছে ‘চারুলতা’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে তৈরি এই সিনেমাটি পরিচালকের নিজেরও অন্যতম প্রিয় কাজ ছিল।
-
অঙ্কুর (১৯৭৪): শ্যাম বেনেগালের প্রথম পরিচালিত এই সিনেমাটি হায়দ্রাবাদের এক সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত। বর্ণবৈষম্য এবং ধনী-গরিবের বিভেদকে কেন্দ্র করে নির্মিত এই ছবিটি বার্লিন উৎসবে গোল্ডেন বেয়ারের জন্য মনোনীত হয়েছিল।
-
পিয়াসা (১৯৫৭): গুরু দত্ত পরিচালিত এই সিনেমাটিকে শৈল্পিক এবং বাণিজ্যিক সিনেমার এক অনবদ্য মিশ্রণ হিসেবে দেখা হয়। ‘টাইম’ পত্রিকার সর্বকালের সেরা ১০০ সিনেমার তালিকায়ও এটি জায়গা করে নিয়েছিল।
-
শোলে (১৯৭৫): রমেশ সিপ্পি পরিচালিত এই বাণিজ্যিক সিনেমাটি ভারতীয় পপ কালচারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। মুক্তির পর প্রায় দুই দশক ধরে এটি ছিল ভারতের সর্বোচ্চ আয় করা সিনেমা।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট: সিক্যুয়েল এবং নতুন চ্যালেঞ্জ
এই ক্লাসিকগুলো যখন ভারতীয় সিনেমার ভিত্তি স্থাপন করেছে, তখন বর্তমান প্রজন্মের পরিচালকরা নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। সম্প্রতি, জনপ্রিয় তামিল সিনেমা ‘৯৬’-এর পরিচালক প্রেমকুমার তাঁর নতুন কাজ এবং চলচ্চিত্র জগতের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন।
-
সমালোচকদের ভূমিকা এবং সিনেমার ব্যবসা: নিজের ছবি ‘মেইয়াজাগান’-এর প্রথম বর্ষপূর্তিতে এক সাক্ষাৎকারে প্রেমকুমার বলেন, “যদি ‘মেইয়াজাগান’ মালয়ালম ভাষায় মুক্তি পেত, তাহলে হয়তো তামিল দর্শকরাও ছবিটিকে আরও বেশি উপভোগ করতে পারতেন। দুর্ভাগ্যবশত, আমরা প্রত্যাশিত আয় করতে পারিনি।” তিনি আরও যোগ করেন, “আজকের দিনে পাইরেসির চেয়েও বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছেন কিছু সমালোচক। আমার সমালোচকদের কোনো ভয় নেই, এবং সেই কারণেই আমি এই কথাগুলো বলছি।”
-
‘৯৬’-এর সিক্যুয়েল নিয়ে আত্মবিশ্বাস: প্রেমকুমার তাঁর অত্যন্ত সফল ছবি ‘৯৬’-এর সিক্যুয়েল নিয়েও কথা বলেন। তিনি জানান যে ‘৯৬ পার্ট II’-এর চিত্রনাট্য লেখা সম্পূর্ণ হয়েছে এবং এটি তাঁর জীবনের সেরা কাজ বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, “অনেকেই আমাকে সিক্যুয়েল তৈরির ঝুঁকি নিতে বারণ করেছিলেন, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিক্যুয়েল মূল সিনেমার মতো সফল হয় না। কিন্তু চিত্রনাট্যটি আমার বন্ধুদের শোনানোর পর তারা বলেন যে এটি প্রথম পর্বের থেকেও অনেক ভালো হয়েছে। এতে আমার আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বেড়ে গেছে।” প্রযোজক ইশারি কে গণেশও চিত্রনাট্য শুনে এতটাই মুগ্ধ হন যে তিনি প্রেমকুমারকে একটি সোনার চেন উপহার দেন।
-
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং অন্যান্য প্রজেক্ট: প্রেমকুমার আরও জানান যে তিনি অভিনেতা চিয়ান বিক্রমকে ২-৩টি গল্প শুনিয়েছিলেন এবং বিক্রম একটি পছন্দ করলেও শেষ পর্যন্ত সেই প্রজেক্টটি বাস্তবায়িত হয়নি। ‘৯৬’-এর সিক্যুয়েলের কাস্টিং নিয়ে তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, “আমি বিজয় সেতুপতি এবং ত্রিশাকে নিয়েই এই সিনেমাটি করতে চাই। যদি তাঁরা না থাকেন, তাহলে এই সিনেমাটিই হবে না।”
এছাড়াও শোনা যাচ্ছে যে প্রেমকুমার বর্তমানে ফাহাদ ফাসিলকে নিয়ে একটি অ্যাকশন-থ্রিলার তৈরির পরিকল্পনা করছেন। ‘পথের পাঁচালী’ থেকে ‘৯৬’, ভারতীয় সিনেমার এই দীর্ঘ যাত্রাপথ প্রমাণ করে যে ভালো গল্প বলার ইচ্ছে এবং ক্ষমতা আজও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মূল চালিকাশক্তি।