উদ্বোধনী অনুষ্ঠান
বৃহস্পতিবার বলরামপুর গার্ডেনে দশ দিনব্যাপী জাতীয় বইমেলার উদ্বোধন করেন গভর্নর আনন্দিবেন প্যাটেল। মেলায় বই, স্টেশনারি ও বিভিন্ন সামগ্রীর ১২০টিরও বেশি স্টল রয়েছে। উদ্বোধনের পর গভর্নর বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন, বই কেনেন এবং বিক্রেতাদের সাথে কথা বলেন। এসময় তিনি বইয়ের গুরুত্ব ও পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার ওপর জোর দেন। তিনি ভগবত, মহাভারত, রামায়ণের গল্প এবং স্বামী বিবেকানন্দের ‘মেরা ভারত অমর ভারত’-এর মতো বই কেনেন।
পাঠকদের আগ্রহ ও তরুণদের পছন্দ
মেলায় ফিকশন, নন-ফিকশন, ইতিহাস, পুরাণ, বাস্তববাদ, সেলফ হেল্প, ক্রাইম, থ্রিলার, রোম্যান্স, হরর, আত্মজীবনী এবং জীবনীসহ বিভিন্ন ধরনের বই পাওয়া যাচ্ছে। তরুণ পাঠকদের মধ্যে ‘হোমো সেপিয়েন্স’ এবং ‘ইকিগাই’-এর মতো নন-ফিকশন বইয়ের প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখা গেছে। অন্যদিকে, অভিভাবকদের সাথে আসা শিশুরা এনিড ব্লাইটনের রূপকথা এবং ‘অ্যাডভেঞ্চারস অফ ডোরা’ ও ‘বার্বি টেলস’-এর মতো বই কিনছে। মেলায় ঘুরতে আসা ২৩ বছর বয়সী শমিতা ব্যানার্জী ও তার বন্ধু বর্তিকা চৌহান ‘Why I am A Hindu’ বইটির দুটি কপি কেনেন। বর্তিকা বলেন, “ছোটবেলা থেকে আমরা ফিকশন, ইতিহাস ও থ্রিলার পড়েছি, এখন আমরা একটি নতুন ধারা সম্পর্কে জানতে চাই।” অন্যদিকে, ২৫ বছর বয়সী অজিতেশ সিধওয়ানি জানান, “আমি নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে এবং ইতিবাচকতা অর্জনের জন্য সেলফ-হেল্প বই ‘ইকিগাই’ কিনেছি।” অনেক তরুণীকে দলবেঁধে সেলফি তুলতে এবং রিল তৈরি করতেও দেখা যায়। মেলায় একটি ফুড কোর্টও রয়েছে, যেখানে হালকা নাস্তা ও পানীয়ের ব্যবস্থা আছে।
চিরায়ত বাংলা উপন্যাসের আবেদন
একদিকে যখন তরুণ প্রজন্মের মাঝে নন-ফিকশন এবং সেলফ-হেল্প বইয়ের এত চাহিদা, তখনও মেলার বিভিন্ন স্টলে চিরায়ত বাংলা সাহিত্যের প্রতি পাঠকদের ভালোবাসা চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে বিচ্ছেদ ও আবেগময় প্রেমের উপন্যাসগুলো এখনো সব প্রজন্মের পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়। নিচে পাঠকদের হৃদয়ে দাগ কেটে যাওয়া এমন কিছু কালজয়ী উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো।
দেবদাস
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই অমর সৃষ্টি বিয়োগাত্মক প্রেমকাহিনীর এক মাইলফলক। দেবদাস ও পার্বতীর শৈশবের বন্ধুত্ব প্রেমে রূপ নিলেও সামাজিক বাস্তবতার কারণে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। প্রেমিকার স্মৃতি ভুলতে দেবদাসের মদের আশ্রয় নেওয়া এবং পরিশেষে পার্বতীর বাড়ির সামনে তার করুণ মৃত্যু পাঠকের মনে গভীর ছাপ ফেলে যায়।
শেষের কবিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উপন্যাসে অমিত ও লাবণ্যের প্রেম ও বিচ্ছেদের কাব্যিক উপাখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। অমিতের বাগদত্তা কেতকীর আগমনে তাদের সম্পর্ক বাস্তবতার মুখোমুখি হয় এবং ভেঙে যায়। উপন্যাসের শেষে তাদের বিচ্ছেদ হলেও একে অপরের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা অটুট থাকে, যা পাঠকদের এক ভিন্ন ধরনের উপলব্ধির জগতে নিয়ে যায়।
পথের পাঁচালী
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কালজয়ী উপন্যাসে অপু ও দুর্গার ভাই-বোনের নির্মল ভালোবাসার চিত্র ফুটে উঠেছে। বোনের মৃত্যুতে অপুর শৈশবের নিঃসঙ্গতা এবং গ্রামীণ জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পাঠকের মনকে আর্দ্র করে তোলে। এই উপন্যাসের মাধ্যমে বিচ্ছেদ কেবল নর-নারীর প্রেমেই সীমাবদ্ধ নয়, তা নতুন করে উপলব্ধি করা যায়।
পুতুলনাচের ইতিকথা
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ডাক্তার শশী এবং গ্রামের বধূ কুসুমের অব্যক্ত ভালোবাসার গল্প দেখানো হয়েছে। সামাজিক সীমাবদ্ধতা ও বাস্তবতার কাছে তাদের ভালোবাসার করুণ পরিণতি ঘটে। ক্ষয়িষ্ণু গ্রামীণ সমাজের প্রেক্ষাপটে চরিত্রগুলোর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব পাঠকদের গভীরভাবে নাড়া দেয়।
কবি
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি’ উপন্যাসের নায়ক নিতাইচরণ, একজন কবিয়াল। ঠাকুরঝি এবং বসন্ত—দুই নারীর প্রতি তার ভালোবাসা ভাগ্যক্রমে পরিণতি পায় না। জীবনের নানা বাঁকে প্রিয়জনদের হারিয়ে তার নিঃসঙ্গতা এবং অনুশোচনা নিতাইয়ের লেখা গানের মাধ্যমেই প্রকাশ পায়, যা পাঠকদের ব্যথিত করে।
মেমসাহেব
নিমাই ভট্টাচার্যের লেখা এই রোমান্টিক উপন্যাসটি কয়েকটি চিঠির সংকলন। সাংবাদিক বাচ্চুর তার প্রেমিকা, যাকে সে ‘মেমসাহেব’ বলে ডাকত, তার সাথে কাটানো মুহূর্ত এবং তাদের বিচ্ছেদের করুণ কাহিনী চিঠির মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। প্রেম ও বিচ্ছেদের এই গল্প পাঠকদের গভীরভাবে আবেগাপ্লুত করে।
ন হন্যতে
লেখিকা মৈত্রেয়ী দেবীর আত্মজীবনীমূলক এই উপন্যাসে তার নিজের জীবনের এক প্রেমকাহিনী বর্ণিত হয়েছে। রোমানীয় যুবক মির্চা এলিয়েডের সাথে তার গভীর প্রেম তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটে পরিণতি পায়নি। বহু বছর পর লেখা এই উপন্যাস তাদের বিচ্ছেদের পেছনের সত্য এবং অনুভূতির গভীরতাকে তুলে ধরে।
শবনম
সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা ‘শবনম’ এক বাঙালি যুবকের সাথে তুর্কি বংশোদ্ভূত আফগান তরুণী শবনমের প্রেম, পরিণয় এবং বিচ্ছেদের অসাধারণ এক গল্প। তাদের ভালোবাসার দিনগুলো যেমন মধুর ছিল, তেমনি তাদের বিচ্ছেদ ছিল করুণ। উপন্যাসটি শেষ হওয়ার পরও শবনমের ফিরে আসার অপেক্ষা পাঠকের মনে রেশ রেখে যায়।
হাজার বছর ধরে
জহির রায়হানের এই উপন্যাসে গ্রামীণ জীবনের পটভূমিতে মন্তু ও টুনির নিষ্পাপ ভালোবাসার গল্প তুলে ধরা হয়েছে। সামাজিক কুসংস্কার ও বিধিনিষেধের কারণে তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। এই গল্প যেন গ্রাম বাংলার হাজারো মানুষের না বলা ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি।
কোথাও কেউ নেই
হুমায়ূন আহমেদের এই উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত নাটকটি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। কেন্দ্রীয় চরিত্র বাকের ভাই, এলাকার একজন মাস্তান প্রকৃতির লোক, মুনা নামের এক সাধারণ মেয়েকে ভালোবাসত। মিথ্যা মামলায় বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয় এবং তাদের ভালোবাসার করুণ পরিণতি ঘটে। এই বিয়োগাত্মক কাহিনী আজও পাঠক ও দর্শকের মনে একইভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে।