৮২-তম ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগে আমন্ত্রণ এবং ৩০-তম বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী চলচ্চিত্র হিসেবে প্রদর্শিত হওয়ার পর থেকেই পরিচালক পার্ক চ্যান-উকের নতুন সিনেমা ‘অছলসুগাঅপদা’ (কোরীয়: 어쩔수가없다; অর্থ: ‘আর কোনো উপায় নেই’) চলচ্চিত্র সমালোচক এবং সাধারণ দর্শকদের কাছ থেকে বিপুল প্রশংসা লাভ করছে। সম্প্রতি বুসান চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটির এশিয়ান প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই এটি ঘিরে দর্শকদের মধ্যে প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।
গল্পের পটভূমি: এক ব্যক্তির অস্তিত্বের সংকট
‘অছলসুগাঅপদা’ সিনেমার গল্পটি ‘মানসু’ (অভিনয়ে লি বিয়ং-হুন) নামের একজন মধ্যবয়সী ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। মানসু একজন সফল কাগজ সংস্থার বিশেষজ্ঞ, যিনি ২৫ বছর ধরে তাঁর পেশায় কর্মরত। নিজের জীবন নিয়ে তিনি এতটাই সন্তুষ্ট ছিলেন যে তাঁর মনে হতো, “আমি জীবনে সবকিছুই লাভ করেছি”। তাঁর সাজানো সংসারে রয়েছে প্রেমময়ী স্ত্রী ‘মিরি’ (অভিনয়ে সন ইয়ে-জিন), দুই সন্তান এবং একটি সুন্দর দোতলা বাড়ি। কিন্তু হঠাৎ করেই তাঁর সংস্থা একটি আমেরিকান কোম্পানির কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়ায় শুরু হয় কর্মী ছাঁটাই। বহু সহকর্মীর কর্মচ্যুতির প্রতিবাদ করতে গিয়ে মানসু নিজেও কর্মচ্যুত হন।
এই আকস্মিক বিপর্যয়ে তাঁর পায়ের তলার মাটি সরে যায়। নিজের পরিবার এবং অনেক কষ্টে গড়া বাড়িটিকে রক্ষা করার জন্য, মানসু তিন মাসের মধ্যে নতুন চাকুরি খুঁজে বার করার শপথ নেন। কিন্তু এক বছর কেটে গেলেও তিনি কোনো চাকুরি পান না। জীবিকা নির্বাহের জন্য তাঁকে একটি সুপারমার্কেটে কাজ নিতে হয়, কিন্তু সেখানেও অপমানিত হয়ে অন্তর্বাস পরা অবস্থায় তাঁকে বিতাড়িত হতে হয়। ঋণের বোঝা বাড়তে থাকায় তাঁর বাড়িটিও হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম হয়। এই পরিস্থিতিতে, খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে মানসু এক ভয়ানক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন—চাকুরির জন্য তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের একে একে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি।
কঠোর বাস্তবতা ও ব্ল্যাক কমেডির মিশ্রণ
পরিচালক পার্ক চ্যান-উক এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পুঁজিবাদী সমাজের কঠোর বাস্তবতা, যেমন—কর্পোরেট পুনর্গঠন, বেকারত্ব, মধ্যবয়সীদের চাকুরির সংকট এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো বিষয়গুলি অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে চিত্রিত করেছেন। মানসুর এই মরিয়া হয়ে ওঠার করুণ কাহিনীকে তিনি তাঁর নিজস্ব শৈলীতে ব্ল্যাক কমেডি এবং স্ল্যাপস্টিক কমেডির আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন। সিনেমার কিছু দৃশ্য, যেমন—উচ্চগ্রামে বাজতে থাকা গানের সঙ্গে মানসুর অদ্ভুত মারপিট কিংবা বিচিত্র পোশাকে একটি অনুষ্ঠানে তাঁর নাচ, দর্শকদের হাসাতে বাধ্য করলেও তার গভীরে নিহিত সামাজিক সংকটকে আরও প্রকট করে তোলে। গল্পটি মূলত ডোনাল্ড ই. ওয়েস্টলেকের ‘দ্য অ্যাক্স’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত।
শিল্পীদের অনবদ্য অভিনয়
‘অছলসুগাঅপদা’ চলচ্চিত্রটিকে সমালোচকরা “অভিনয়ের মহারথীদের জাদুকরী প্রদর্শনী” রূপে আখ্যায়িত করেছেন। লি বিয়ং-হুন একজন সাধারণ, পরিবারপ্রেমী মানুষ থেকে চরম পরিস্থিতিতে এক ভয়ঙ্কর পরিকল্পনাকারীতে রূপান্তরিত হওয়ার চরিত্রটি অনবদ্যভাবে মূর্ত করে তুলেছেন। তাঁর অভিনয় এতটাই নিখুঁত যে দর্শকরা সহজেই তাঁর মানসিক অবস্থার সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন। অন্যদিকে, সন ইয়ে-জিন স্বল্প উপস্থিতিতেও তাঁর বলিষ্ঠ অভিনয়ের ছাপ রেখেছেন। পার্শ্ব চরিত্রে পার্ক হি-সুন, লি সাং-মিন এবং ইয়ম হে-রানের মতো দক্ষ শিল্পীরাও তাঁদের নিজ নিজ চরিত্রে প্রাণ সঞ্চার করেছেন।
পরিচালকের মুন্সিয়ানা ও সামাজিক বার্তা
পরিচালক পার্ক চ্যান-উক তাঁর স্বকীয় ভিজ্যুয়াল শৈলী ও নান্দনিকতার দ্বারা দর্শকদের পুনরায় মুগ্ধ করেছেন। সিনেমার অসাধারণ চিত্রগ্রহণ এবং আবহসংগীত দর্শকদের গল্পের গভীরে পৌঁছে দেয়। পরিচালক জানিয়েছেন, “আমেরিকান উপন্যাসটিকে কোরীয় প্রেক্ষাপটে রূপান্তরিত করার সময় আমি বাড়ির প্রতি মানুষের মোহ এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজে একজন পুরুষের সীমাবদ্ধতা ও নির্বুদ্ধিতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।” তিনি বিশ্বাস করেন যে কোরীয় দর্শকরা এই বিষয়গুলি আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। সিনেমার শেষ দৃশ্যটি দর্শকদের মনে এক তিক্ত অনুভূতি রেখে যায়, যা তাঁদের দীর্ঘ সময় ধরে ভাবাতে বাধ্য করবে।
আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর মুক্তি পেতে চলা ১৩৯ মিনিটের এই চলচ্চিত্রটি এই বছরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিনেমা হিসেবে দর্শকদের মন জয় করবে বলে আশা করা হচ্ছে।