দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্র শিল্প যখন একের পর এক ফ্লপের কারণে গভীর সংকটে ভুগছে, তখন পরিচালক পার্ক চান-উকের নতুন সিনেমা ‘ওজলসুগাওবদা’ (Eojjeolsuga-eopda) আশার আলো নিয়ে এসেছে। ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ব্যাপক প্রশংসার পর, ছবিটি মুক্তির আগেই বিদেশে অগ্রিম বিক্রির মাধ্যমে তার নির্মাণ ব্যয় তুলে নিতে সক্ষম হয়েছে। এই সাফল্য এমন এক সময়ে এলো যখন কোরিয়ান সরকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির পুনরুজ্জীবনের জন্য একটি বিশাল বাজেট ঘোষণা করেছে।
ভেনিসে ঝড় তুলেছে ‘ওজলসুগাওবদা’
থ্রিলার এবং ব্ল্যাক কমেডির মিশ্রণে তৈরি পার্ক চান-উকের সিনেমা ‘ওজলসুগাওবদা’ ৮২তম ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হওয়ার পর থেকেই বিশ্বজুড়ে সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করেছে। ছবিটি মুক্তির পর আমেরিকার বিখ্যাত চলচ্চিত্র রিভিউ সাইট ‘রটেন টম্যাটোস’-এ ১০০% ফ্রেশ রেটিং পেয়েছে এবং এখনও পর্যন্ত তা বজায় রেখেছে।
বিশ্বের তাবড় সংবাদমাধ্যমগুলো ছবিটির ভূয়সী প্রশংসা করেছে। BBC একে “এই বছরের ‘প্যারাসাইট'” এবং “বিমুগ্ধকর मनोरंजक কোরিয়ান মাস্টারপিস” বলে অভিহিত করেছে। ভ্যারাইটি লিখেছে, “পার্ক চান-উক যে বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা এবং পরিশীলিত চলচ্চিত্র নির্মাতা, এই সিনেমাটি তার প্রমাণ।” দ্য গার্ডিয়ান এবং ওয়াশিংটন পোস্টের মতো গণমাধ্যমগুলোও ছবিটিকে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা সিনেমার অন্যতম দাবিদার হিসেবে উল্লেখ করেছে। এই বিপুল আন্তর্জাতিক প্রশংসার কারণে ছবিটি বিভিন্ন দেশে মুক্তির আগেই বড় অংকের অর্থে বিক্রি হয়ে গেছে।
মুক্তির আগেই লাভের মুখ
মিরা অ্যাসেট সিকিউরিটিজের একটি সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ছবিটি বিদেশে অগ্রিম বিক্রির আয় থেকেই তার ব্রেক-ইভেন পয়েন্ট (নির্মাণ ব্যয়) অতিক্রম করেছে। প্রায় ১৭ বিলিয়ন ওন (দক্ষিণ কোরিয়ান মুদ্রা) বাজেটে নির্মিত এই সিনেমার ব্রেক-ইভেন পয়েন্ট ধরা হয়েছিল প্রায় ৫০ লক্ষ দর্শক। কিন্তু বিদেশে এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বিক্রির অসাধারণ সাফল্য সেই লক্ষ্যকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। প্রযোজনা সংস্থা CJ ENM যদিও এই বিষয়ে সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তবে তারা স্বীকার করেছে যে বিদেশের বাজারে ছবিটি দুর্দান্ত ব্যবসা করেছে।
এই সাফল্য কোরিয়ান চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য একটি বড় স্বস্তির খবর, কারণ এই বছর বেশিরভাগ সিনেমাই ১০ লক্ষ দর্শকও টানতে পারেনি।
এক দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রজেক্ট
‘ওজলসুগাওবদা’ ছবিটি পরিচালক পার্ক চান-উকের ২০ বছরের একটি স্বপ্নের প্রজেক্ট। তিনি ১৯৯৭ সালে ডোনাল্ড ই. ওয়েস্টলেকের লেখা ‘দ্য এক্স’ উপন্যাসটি পড়ার পরেই এটিকে সিনেমায় রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু বাজেট সংক্রান্ত সমস্যার কারণে এতদিন তা সম্ভব হয়নি। অবশেষে ২০২২ সালে তার ‘ডিসিশন টু লিভ’ সিনেমার মুক্তির পর এই নতুন সিনেমার কাজ শুরু হয়।
ছবিটির গল্প এক মধ্যবিত্ত চাকুরীজীবীকে নিয়ে, যে হঠাৎ করে চাকরি হারানোর পর তার পরিবার এবং বাড়ি বাঁচানোর জন্য এক অন্যরকম সংগ্রামে নামে। এতে অভিনয় করেছেন লি বিয়ং-হুন, সন ইয়ে-জিন, পার্ক হি-সুন এবং চা সেউং-ওনের মতো কোরিয়ার জনপ্রিয় তারকারা।
সিনেমা শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের পদক্ষেপ
কোরিয়ান সিনেমার এই সংকটময় পরিস্থিতিতে আশার আলো দেখিয়েছে দেশের সরকার। সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও পর্যটন মন্ত্রণালয় আগামী বছরের জন্য চলচ্চিত্র খাতের বাজেট প্রায় ৮০.৮% বৃদ্ধি করে ১৪৯.৮ বিলিয়ন ওন করার কথা ঘোষণা করেছে। যা কোরিয়ান সিনেমার ইতিহাসে (২০২২ সালের কোভিড-১৯ অতিমারীর সময়কালীন জরুরি সহায়তা ছাড়া) এযাবৎকালের সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ।
মন্ত্রণালয়ের মতে, কোরিয়ান চলচ্চিত্র শিল্পকে দীর্ঘস্থায়ী মন্দা থেকে বের করে আনার জন্য এই “সিপিআর দেওয়ার মতো জরুরি পদক্ষেপ” নেওয়া অপরিহার্য ছিল।
নতুন বাজেটের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা
এই বর্ধিত বাজেটটি কোরিয়ান চলচ্চিত্র শিল্পের সার্বিক উন্নয়নে ব্যবহার করা হবে। এর মধ্যে মাঝারি বাজেটের সিনেমার নির্মাণে সহায়তা দ্বিগুণ করে ২০০ বিলিয়ন ওন এবং চিত্রনাট্য উন্নয়নের জন্য বাজেট বাড়িয়ে ৮০ বিলিয়ন ওন করা হয়েছে। এছাড়াও, স্বাধীন ও শৈল্পিক সিনেমার প্রদর্শনী এবং নতুন পরিচালকদের সহায়তা করার জন্য বিশেষ তহবিল গঠন করা হয়েছে।
বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সরকার ‘মোটে ফান্ড’ (Mother Fund) নামক একটি বিশেষ তহবিলে বিনিয়োগ দ্বিগুণ করে ৭০০ বিলিয়ন ওন করেছে, যা প্রায় ১,৪০০ বিলিয়ন ওনের একটি নতুন বিনিয়োগ তহবিল তৈরি করবে। এর পাশাপাশি, এআই-ভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং بوسان-এ একটি ‘ভার্চুয়াল প্রোডাকশন স্টুডিও’ তৈরির মতো আধুনিক প্রযুক্তিগত উদ্যোগেও বড় অংকের অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। সরকারের লক্ষ্য, কোরিয়ান সিনেমাকে আবার বিশ্ব দরবারে “কে-কন্টেন্ট”-এর প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।