Breaking
17 আগস্ট 2025, রবি

আধুনিক কথাসাহিত্যের পথিকৃৎ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ

সাহিত্যজগতের উজ্জ্বল তারকা

বাংলা কথাসাহিত্যে যাঁদের অবদান গভীর ছাপ ফেলেছে, তাঁদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অন্যতম। তিনি ছিলেন এমন এক সাহিত্যিক, যিনি ভাষা, বিষয় এবং কাহিনির গঠনে নিজস্ব ধারা সৃষ্টি করেন। ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, এবং সামাজিক ভণ্ডামির বিরুদ্ধে তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে দৃঢ় অবস্থান নেন। তাঁর রচনায় যে বাস্তবতা ও অন্তর্দৃষ্টি উঠে আসে, তা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

উপন্যাস ও নাটকে বিপ্লবী চিন্তা

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কালজয়ী সৃষ্টি ‘লালসালু’ বাংলা উপন্যাসে এক মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এ ছাড়াও ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ও ‘দুই তীর ও অন্যান্য গল্প’ তাঁর অনন্য সাহিত্যকীর্তি। তাঁর রচিত নাটক ‘বহিপীর’ সমাজের নানা দিক বিশ্লেষণ করে। সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি শুধুই গল্প বলেননি, বরং পাঠককে ভাবতে বাধ্য করেছেন।

প্রভাবশালী সাহিত্যিকের জীবনযাত্রা

১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট চট্টগ্রামের ষোলশহরে জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। পিতা সৈয়দ আহমাদুল্লাহ ছিলেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং মাতা নাসিম আরা খাতুন শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা নারী। মাত্র আট বছর বয়সে মাতৃহারা হয়ে, শৈশব থেকে তাঁকে বারবার স্থানান্তর হতে হয়েছে বাবার চাকরির সূত্রে।

ছোটবেলা থেকেই তাঁর সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক ছিল। মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফেনী, ঢাকা, কৃষ্ণনগরসহ বহু জায়গায় স্কুলজীবন কাটে তাঁর। ফেনী হাইস্কুলে পড়ার সময় তিনি ‘ভোরের আলো’ নামে হাউস ম্যাগাজিন চালু করেন। চট্টগ্রাম জেলা স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর, তিনি কুড়িগ্রাম হাইস্কুল থেকে ১৯৩৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন।

শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চার উন্মেষ

ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালেই তাঁর প্রথম গল্প ‘সীমাহীন এক নিমেষে’ কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। সে সময় কলেজে অধ্যাপক ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ ও পরিমল কুমার বসু, যাঁদের তত্ত্বাবধানে সাহিত্যচর্চা চলত। কলেজজীবনেই তিনি প্রগতি লেখক সংঘের সঙ্গে যুক্ত হন এবং সোমেন চন্দের মতো সাহিত্যিকদের সঙ্গে কাজ করেন।

ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েটে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি বিএ পড়তে ভর্তি হন। যদিও বাবার চাকরির কারণে তাঁকে নানা জায়গায় স্থানান্তর হতে হয়, তবুও আনন্দমোহন কলেজ থেকে তিনি সম্মানজনকভাবে স্নাতক শেষ করেন। কৃষ্ণনগর কলেজে থাকাকালীন অধ্যাপক আবুল ফজলের মতো গুণী শিক্ষকের পাঠ পেয়েছিলেন।

সাহিত্যের প্রভাব ও উত্তরাধিকার

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে শুধু পাঠক নয়, পরবর্তী প্রজন্মের বহু সাহিত্যিককে প্রভাবিত করেছেন। হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির প্রমুখ তাঁর লেখনী থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন। অনেকেই তাঁকে বাংলাদেশি সাহিত্যের চলমান প্রতিষ্ঠান বলে উল্লেখ করেছেন।

বিদেশে প্রবাসজীবন ও অন্তিম পরিণতি

তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায় কেটেছে বিদেশে। ফ্রান্সের প্যারিসে তিনি পরবাস জীবনযাপন করেন এবং সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অন্যদিকে, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, যিনি একইভাবে সুদর্শন ও প্রতিভাবান লেখক ছিলেন, তাঁর মৃত্যুও ঘটে রোম শহরে। দু’জন মহান সাহিত্যিকই স্বদেশের মাটির বাইরে বিশ্রাম নেন চিরতরে।