Breaking
18 এপ্রিল 2025, শুক্র

ক্যান্টিনের গল্পে নারীর লড়াই আর স্বপ্নের রান্নাঘর

রান্না শুধুই স্বাদের ব্যাপার নয়, এর পেছনে থাকে যত্ন, ধৈর্য আর অনুভূতির মিশেল। পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় নির্মিত ‘বৌদি ক্যান্টিন’ ছবিটি সেই অনুভবগুলোরই এক নিখুঁত উপস্থাপন। এখানে রান্না শুধু খাবার নয়, বরং এক প্রতিবাদ, এক যাত্রাপথ—একজন নারীর নিজের পরিচয় ফিরে পাওয়ার সংগ্রাম।

ছবির মূল কাহিনি ঘোরে সৌরীশ (পরমব্রত) এবং পৌলমী (শুভশ্রী) দম্পতিকে ঘিরে। দু’জনেই কর্মজীবনে অসন্তুষ্ট। সৌরীশ একটি পত্রিকায় মহিলাদের নিয়ে নানা লেখা লেখে, কিন্তু সে আসলে চায় একজন স্বাধীন লেখক হতে। অন্যদিকে পৌলমী একজন স্কুলশিক্ষিকা, কিন্তু তার প্রকৃত ভালোবাসা রান্নায়। সংসারে কারও অভাব না থাকলেও নিজের ইচ্ছেগুলো বারবার চাপা পড়ে যায় চারপাশের প্রত্যাশায়।

পৌলমীর রান্নার প্রতি ভালোবাসা রীতিমতো গভীর। শ্বশুরবাড়ির নিয়ম-কানুন, শাশুড়ির বিরোধিতা—সব কিছু সামলেও তার মন পড়ে থাকে হেঁশেলেই। তাই যখন একটি খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসা করার সুযোগ আসে, সে তা বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করে। এই উদ্যোগ সফল হয় এবং “বৌদি ক্যান্টিন” হয়ে ওঠে মানুষের পছন্দের জায়গা। কিন্তু এই সাফল্যের সঙ্গেই আসে জীবনজুড়ে নানা টানাপোড়েন।

ছবিটি এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। রান্নার গল্পের আড়ালে পরিচালক ধরেছেন একাধিক সামাজিক ইস্যু—বাঙালিদের ব্যবসার প্রতি অনাগ্রহ, আর্থ-সামাজিক বৈষম্য, নারীদের পেশা নির্বাচনের স্বাধীনতা, শহুরে জীবনে সামাজিক ট্যাবু, প্রেম ও ঈর্ষার টানাপোড়েন, পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, শাশুড়ি-বউমার সম্পর্কের টানাপোড়েন, এমনকি চিট ফান্ড ও স্টার্টআপের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে গল্পে। এতসব বিষয়ের মধ্যে থেকেও ছবিটি কোথাও অগোছালো হয়নি, বরং প্রতিটি দিক চমৎকারভাবে উপস্থাপিত।

এই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় সম্পদ এর সংলাপ ও সম্পাদনা। প্রতিটি দৃশ্য পরিমিত, প্রয়োজনীয় এবং সুনিপুণভাবে বোনা। কোথাও কোনও অপ্রয়োজনীয় বাড়তি অংশ নেই। ছবির প্রত্যেক চরিত্র বিশ্বাসযোগ্য এবং জীবন্ত। শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিনয়, বিশেষ করে পৌলমীর চরিত্রে, অত্যন্ত সাবলীল এবং আবেগঘন। পরমব্রত নিজেও চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন।

‘বৌদি ক্যান্টিন’ আসলে একটি প্রতীক—নারী যখন নিজের ইচ্ছেকে গুরুত্ব দেয়, নিজের পথ নিজে তৈরি করে নেয়, তখন সেই পথ কতটা শক্তিশালী হতে পারে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে এই ছবি। রান্নাঘর যে বন্দিদশার প্রতীক নয়, বরং হতে পারে স্বাধীনতার একটি রূপ, তা বারবার ফুটে উঠেছে কাহিনির পরতে পরতে।

এই ছবিটি শুধু নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে না, বরং সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণা, পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, শহরাঞ্চলের আভিজাত্যবোধ সবকিছুকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। রান্না এখানে এক রাজনৈতিক অবস্থান, আত্মপ্রকাশের এক মাধ্যম, আর ‘বৌদি ক্যান্টিন’ সেই সংগ্রামের নাম, যেখানে প্রতিটি পদই এক একটি গল্প।

‘বৌদি ক্যান্টিন’ দেখার পর দর্শক শুধু এক সিনেমা দেখে ওঠেন না, বরং নিয়ে ওঠেন এক অনুভব, এক অনুপ্রেরণা। সমাজ ও পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে থেকেও একজন নারী কীভাবে নিজের স্বপ্ন পূরণের পথ তৈরি করতে পারে, এই ছবির প্রতিটি দৃশ্যে সেই বার্তা পৌঁছে যায় হৃদয় ছুঁয়ে।